শিল্প গড়ে তোলার প্রধান নির্ণায়ক সমূহ হচ্ছে উপযূক্ত স্থান, শ্রমশক্তি, সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাজারের নৈকট্য, শক্তি সম্পদের সহজলভ্যতা ইত্যাদি। কালীগঞ্জে রয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ঘেঁষে সড়ক ও রেলপথ সংলগ্ন কালীগঞ্জ, বাহাদুরসাদী ও জামালপুর ইউনিয়নের বিসত্মীর্ণ এলাকা, রয়েছে ৬৩,৩৫৫ জন বেকার জনগোষ্ঠী হিসাবে সহজলভ্য শ্রমিক, রয়েছে পাশ্ববর্তী ঢাকা জেলার বিশাল বাজার। সকল সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাশ্ববর্তী পলাশ ও টঙ্গী অঞ্চলের মত শিল্পায়ন এখানে হয়নি। এর প্রধান কারণ শক্তিসম্পদ প্রাকৃতিক গ্যাসের অভাব। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিছু কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প এখানে গড়ে উঠেছে।
প্রাচীন আমলঃ শীতলক্ষ্যার পাশর্ববর্তী অঞ্চল সমূহে পূর্বে বিখ্যাত মসলিন কাপড় উৎপাদিত হত। কালীগঞ্জ ও জামালপুর ছিল মসলিন সংগ্রহ কেন্দ্র। পরবতীতে মেঘডম্বর শাড়ি উৎপাদনের কথা জানা যায়। নাগরী ও তুমুলিয়া অঞ্চলে এই শাড়ি অধিক উৎপাদিত হত। এ ছাড়া কুটির শিল্প হিসাবে নৌশিল্প, বাঁশ, অধাতব খনিজ দ্রব্যজাত শিল্প, মিষ্টি তৈরি শিল্প ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য। মসলিনের ধারাবাহিকতায় এখানে চরকা ও তাঁত শিল্প অবশিষ্ট রয়েছে কালীগঞ্জের চৌড়া ও আশে-পাশের এলাকায়। তাঁত পণ্যের মধ্যে লুঙ্গি, তোয়ালে, গামছা, চাঁদর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বর্তমান আমলঃ গাজীপুর জেলার অন্যান্য উপজেলা ও পাশর্ববর্তী রূপগঞ্জ ও পলাশ উপজেলার মত না হলেও এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ না থাকা সত্বেও বিদ্যুৎ নির্ভর কয়েকটি শিল্প শীতলক্ষ্যার পাড় ঘেষে গড়ে উঠেছে যা নিম্মরূপঃ-
মসলিন কটন মিলসঃ বাংলাদেশের শিল্প অগ্রসরতা তথা বস্ত্র শিল্পের এক ঐতিহ্যবাহী শিল্প প্রতিষ্ঠানের নাম মসলিন কটন মিলস, কালীগঞ্জ। উপজেলায় এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ টেক্সাটাইল মিল ১৯৫২ সালে ৩ শত বিঘা জমির ওপর ‘‘ইপিআইডিসি’’ কর্তৃক স্থাপিত হয়। ১৯৫৪ সালে উৎপাদন শুরু হলে স্পিনিং বা সুতা বিভাগে টাকুর সংখ্যা ৪৮ হাজার, বয়ন বিভাগে লুম সংখ্যা ৪৯৬ এবং ডাইং ও ফিনিশিং বিভাগ ছিল। ২ হাজার ৮ শতজন শ্রমিক, ২৭০জন কর্মচারী এবং ৩৫জন কর্মকর্তা কর্মরত ছিল। প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার টন পর্যমত্ম সুতা এবং সোয়ালক্ষ মিটার কাপড় উৎপাদিত হত। ১৯৬৮ সালে রূপগঞ্জ থানার ভুলতা গ্রামের জমিদার গুলবক্স ভূইয়া ইপিআইডিসির নিকট থেকে মসলিন কটন মিলটি ক্রয় করেন। ১৯৭২ সালে মিলটি জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৮৩ সালে গুলবক্স ভূইয়ার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা পুনরায় বিটিএমসি’র কাছ থেকে ৫১ ভাগ শেয়ার ক্রয় করে। ১৯৯০ সালে মিলটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে মিলটির স্পিনিং ইউনিট চালু হলেও ১৯৯৩ সালে সম্পূর্ণরুপে বন্ধ হয়ে যায়। ০৮/০৪/২০০৪ তারিকে সরকার পুনরায় মিলটি অধিগ্রহণ করলেও চালু করতে পারেনি।
মসলিন কটন মিল বন্ধ হওয়ার ফলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী বেকার হয়ে পড়ে। পুবালী ব্যাংকের নিকট মিলের দেনার বিষয়টি হাইকোর্টে বিবেচনাধীন থাকায় কর্মকর্তা কর্মচারীরা এখনো তাদের বকেয়া পাওনা পাননি যাদের অনেকেই অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। মিলটি পুনরায় চালূ হরে অত্র অঞ্চলের বেকার সমস্যার পাশাপাশি আইন শৃংখলা পরিস্থিতি আরো উন্নত হবে বলে আশা করা যায়।
ন্যাশনাল জুট মিলস লিমিটেডঃ শীতলক্ষ্যার দুই তীরে বাংলার সোনালী আঁশ পাটকে কেন্দ্র করে অনেক পাটকল গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ঘোড়াশাল পাওয়ার প্লানেটর পাশ দিয়ে প্রবাহিত শীতলক্ষ্যার নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত ন্যাশনাল জুট মিলস লিমিটেড অন্যতম। কালীগঞ্জের বাহাদুরসাদী ইউনিয়নের খলাপাড়া নামক গ্রামে এটি অবস্থিত। ৬৫ একর জমির উপর দুই ইউনিট বিশিষ্ট মিলটি তদানীমত্মন ইস্ট পাকিসত্মান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন এর পৃষ্ঠপোষকতায় এসোসিয়েট জুট মিল হিসাবে ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে সরকার ও ব্যক্তিমালাকানায় যথাক্রমে ৪৯ঃ ৫১ শেয়ার ভিত্তিতে মিলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে মিলটি জাতীয়করণ করা হয়। লোকসানের মুখে ১৯৮২ সালে মূল মালিকদের ফেরৎ দেয়া হয়। ১৯৮৮ সালে মিলটি ইসলাম গ্রুপ ক্রয় করে। ১৯৯৫ সালে ইকবাল কবির মিলটি ক্রয় করলেও জনাব সাইদুল ইসলাম বাবুলের ১৯৯৬ সালে বিক্রয় করে দেয়। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রতিদিন ১০০০ মন পাট কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং সাড়ে পাঁচ হাজার শ্রমিক কর্মরত ছিল। বর্তমানে মিলটি আংশিক চালু রয়েছে, দৈনিক উৎপাদন প্রায় ৩৫ মেঃ টন, কর্মরত আছেন ১৭০ জন। শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য চমৎকার পরিবেশে অবস্থিত মিলটি বিশাল এলাকাকে ব্যবহার করা হলে পাটসহ অন্য যে কোন শিল্পের ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি আসতে পারে, নিরসন হতে পারে অত্র অঞ্জলের প্রকট বেকার সমস্যা।
সিয়াম বাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডঃ জানুয়ারী ২০০২ হতে মে ২০০৩ পর্যমত্ম সময়কালে বাহাদুরসাদী ইউনিয়নের দেওপাড়া গ্রামের শীতলক্ষ্যার পাড় ঘেষে প্রতিষ্ঠিত সিয়াম বাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে ওঠে। ৩.৭৩ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের নাম‘‘White Elephant Brand White Cement”। উৎপাদন ক্ষমতা মাসিক ১০০০ মেঃ টন। শুরুতে প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও টাইলসের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় এর উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে।
ফাহিম ভিলেজঃ শীতলক্ষ্যার পাড়ে কালীগঞ্জের বালীগাঁও মৌজায় ৩৫ বিঘা জমির উপর গড়ে ওঠেছে ফাহিম ভিলেজ। ফাহিম ভিলেজের প্রথম শিল্প প্রকল্প ফাহিম মার্বেল কর্পোরেশন লিঃ ২৫ শে মার্চ ২০০২ তারিখে উদ্বোধন করা হয়। ইটালিয়ান প্রযুক্তি নির্ভর এ প্রকল্পটি জনতা ব্যাংকের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন এই প্রকল্পে আমদানীকৃত ষ্টোন ব্লক ব্যবহার করে রপ্তানীমান সম্পন্ন মার্বেল ও প্রাণাইট টাইলস ওস্লাব তৈরি করা হয়। ফাহিম ভিলেজের দ্বিতীয় প্রকল্প ফাহিম স্যানিটারী ওয়্যারস লিঃ এর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। বর্তমানে প্রায় ২০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী (অধিকাংশই স্থানীয়) এই পল্লীতে কর্মরত থাকলেও অচিরেই তা ৪০০ তে পৌছাবে।
সেভেন সার্কেল (বাংলাদেশ ) লিমিটেডঃ হংকং ভিত্তিক SHUN SHING GROUP এর অধীনে ১৯৯০ সন হতে সেভেন সার্কেল (বাংলাদেশ) লিমিটেড এর কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম অবস্থায় ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, চীন থেকে উন্নতমানের সিমেন্ট আমদানী করে বাজারজাত করা হতো। ফেব্রুয়ারী ২০০১ সালে ব্যক্তিমালাকানায় চরমিরপুর, কালীগঞ্জে দৈনিক ১,৭০০ মেঃ টন সিমেন্ট উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে ২০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এই প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত রয়েছে।
আর কে জুট মিলস্ লিমিটেডঃ প্রায় ছয় একর জমির উপরে মূলগাঁও, কালীগঞ্জে দুই কোটি টাকা বিনিয়োগে সম্পূর্ণ ব্যক্তিমালিকানাধীন আর কে জুট মিলস লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্বে এটি ‘‘ সোনার বাংলা জুট মিল্স’’ নামে সরকারী প্রতিষ্ঠান ছিল। প্রধান উৎপাদিত পণ্য হলো পাটের সূতা, দৈনিক উৎপাদন ১৪-১৫ মেঃ টন। এখানে শ্রমিক-কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন ৪৭২ জন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনঃ গ্রাম অঞ্চলের দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী পুরুষ ও মহিলাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিগত ১৯৯৬-৯৭ সাল থেকে কালীগঞ্জ উপজেলায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বসিক) কাজ করছে। এ সংস্থার অধীনে পরিচালিত পোষাক তৈরি/সেলাই, হাঁস-মুরগী পালন, ছাগল পালন, নার্সারী, মৎস চাষ, গরু মোটা তাজা করণ, দুগ্ধজাত গাভী পালন, বেকারী, মিষ্টান্ন তৈরী, হোটেল-রেষ্টুরেন্ট, টি ষ্টল, ক্ষুদ্র ব্যবসা/মনোহারী দোকান, তাঁত শিল্প, ব্লক ও বাটিক ছাপা, লেপ তোষক তৈরী, ইঞ্জিনিয়ানিং শিল্প, সেনেটারী, লন্ড্রী, ষ্টুডিও, সেলুন, লাইব্রেরী, ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদি খাতে ঋণ প্রদান করে আয় বৃদ্ধি তথা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস